১৬ থেকে ২০শে আগস্টঃ একটি সফল প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের চেপে রাখা ইতিহাস

১৬ই আগস্ট, ঠিক ৭৬ বছর আগে কলকাতা সহ এই বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে এই দিনে কলকাতার বুকে সংঘটিত হয়েছিল এক নারকীয় গণহত্যা, যার নেতৃত্বে ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু ভাগ্যদেবী বোধহয় হিন্দুদের জন্য সে যাত্রায় অন্য কিছু লিখেছিলেন। তাই ১৬ তারিখ শুক্রবারে একতরফা হত্যালীলার শুরু মুসলিম লীগের হাতে হলেও ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখে চির ক্ষমাহীন এই ইসলামিক জেহাদী আগ্রাসনের পাল্টা প্রতিরোধ ও প্রতিশোধের মাধ্যমে শেষ করেছিলাম আমরা, হিন্দুরা। এই প্রতিরোধের বীরগাথার পুরোভাগে ছিলেন গোপাল মুখোপাধ্যায়, যুগল ঘোষ, ভানু বোস এবং অন্যান্যরা।

কি হয়েছিল সেই দিনগুলোতে? ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৬, মুসলিম লীগের চাপে সরকারি ভাবে, ছুটি ঘোষণা করা হয়। সম্মত হন গভর্নর ব্যারোজও। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা লীগের এই কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ইতিপূর্বে কলকাতার ২৪টি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ২২টিতেই হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে মুসলিম অফিসার নিয়োগ করেছিলেন সুরাবর্দি। উদ্দেশ্য- আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও যাতে হিন্দুরা কোনোরকম সাহায্য না পায়।

মুসলিম ন্যাশানাল গার্ডের সদস্যদের ১৬ তারিখ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে মুসলিম ইনস্টিটিউটে সমবেত হ‌ওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। এক্ষেত্রে ইসলামিক গ্রন্থ মুসলিম শরীফ থেকে একটি হাদিসের উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবেনা। ৭৪৫ নং হাদিসে বলা আছে- “নবী যখন‌ কোনো জনপদ আক্রমণ করতেন তখন ভোরবেলায় করতেন।” বাস্তবিকই হিন্দুদের ওপর প্রথম আক্রমণের ঘটনাটি ঘটে ভোরের আলো ফোটা মানিকতলা ব্রিজে, একজন নিরীহ গোয়ালার ওপর। এরপর সকাল সাতটা নাগাদ আক্রান্ত হয় মানিকতলার ‘দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। ৭:৩০ নাগাদ বৌবাজার আর লোয়ার সার্কুলার রোডের জংশনে, শিয়ালদায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জমা হয় মুসলিম জেহাদীরা। বেলা বাড়তেই মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা আক্রান্ত হতে থাকে।

মরুপ্রায় আফগানিস্তানের ঊষর প্রান্তরের এক মুসলমান ফল ব্যবসায়ীর বুকে পিতৃত্বের স্নিগ্ধ বারি সঞ্চার করে আপামর বাঙালীকে স্নেহসিক্ত এক ‘রহমত’ উপহার দিয়েছিলেন যিনি, সেই ছবি বিশ্বাসও রেহাই পাননি। কিংবদন্তি চিত্রাভিনেতা ছবি বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা চালায় পাকিস্তানের দাবিদার কলকাতাবাসী মুসলমানেরা আজ থেকে ঠিক ৭৬ বছর আগে।

এক সময় ছিল এলজেব্রা মানে কেপি বসু। এরিথমেটিক মানেই যাদব চক্রবর্তী। পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জের যাদব চক্রবর্ত্তী ভারতীয় গণিত চর্চার প্রবাদ প্রতিম পুরুষ। বৃটিশ সরকারও তাঁকে ‘গণিত সম্রাট’ উপাধি দিয়েছিলেন। হিন্দী, উর্দু, অসমীয়া, নেপালী ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল তাঁর বই। কথিত আছে সিরাজগঞ্জের স্কুলের ছাত্ররা অঙ্ক পরীক্ষার দিন তাঁর বাড়ির মাটিতে প্রণাম করে যেত। ২৮ বছর আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি। ছাত্রদের মধ্যে মুসলিমই বেশী ছিল। কিন্তু শিক্ষকতার প্রতিদান? ১৬ই আগস্ট তাঁর কলকাতার বাসভবন আক্রান্ত হয় পাকিস্তানপন্থীদের হাতে।

শপিং মল কালচার নতুন হলেও এই কলকাতা শহরে কিন্তু ছিল অন্তত দুটি ডিপার্টমেন্টার স্টোর্স, যারা শপিং মলের আদি পুরুষ। একটি ‘হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন’, অপরটি ‘কমলালয় স্টোর্স’। ধর্মতলা রোডের কমলালয় স্টোর্স ছিল কলকাতার অন্যতম নক্ষত্র। এখানেই ১৯৪৩ সালে বইয়ের দোকান খোলেন রাম হালদার। বিদেশ থেকে সদ্য প্রকাশিত বইও পাওয়া যেত। আর পাশেই ছিল চায়ের দোকান। এই ঘটনা তখন কলকাতার কবি সাহিত্যিক রাজনীতিবিদ শিল্পীদের কাছে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। লেগেই থাকত তারকা সমাবেশ। গোপাল হালদার, সুশোভন সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর… কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন! ১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট বিকালে কলকাতার পাকিস্তানপন্থীদের হাতে সম্পূর্ণ লুঠ হয়ে যায় কমলালয় স্টোর্স। ধ্বংস হয় কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্য।

ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র প্রস্তুতি হিসাবে কলকাতার প্রায় সব পুলিশ বড়কর্তা পদ থেকে হিন্দুদের সরিয়ে মুসলমানদের আনা হয়। হিন্দু পুলিশরা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। ১৬ই আগস্ট সকাল ৯.৩০ এ বড়তলা থানা আক্রমণ করে মুসলিমরা। অসহায় পুলিশ কর্মীরা সাহায্য চায় পুলিশের সদর দপ্তরে। কোনো সাহায্য আসেনি। আবার সাহায্য চায় ৯.৫০ এ। এবারও বৃথা যায়। ধ্বংস হয় বড়তলা থানা। মেট্রো, লাইট হাউস, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার… কলকাতার বিনোদন জগতের চার স্তম্ভ। ১৬ই আগস্ট বিকাল ৪.০৫ এ গণহত্যার কারিগরেরা আক্রমণ করে লাইট হাউস। কাছেই মেট্রো সিনেমা। মেট্রো সিনেমার পাশের কে.সি বিশ্বাসে বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে সমস্ত অস্ত্র লুঠ করে নিয়ে যায় মুসলমানরা। রক্ষা পায়নি এলাকার কোনো হিন্দু দোকান।

এখন যার নাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, আগে তারই নাম ছিল রিপন কলেজ। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ভারত তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রথম বাঙালী প্রধান বিচারপতি বিজন কুমার মুখার্জী, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীরদ সি চৌধুরী, নিমাই ভট্টাচার্য, শঙ্কর, ক্রীড়াবিদ শৈলেন মান্না, বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভাস্কর চিন্তামণি কর প্রভৃতি ছিলেন এই কলেজের ছাত্র। শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ তার সুবিখ্যাত অমৃত বচন প্রদান করে ভারতে ফিরে কলকাতায় এ কলেজের বেদীতে তার ১ম বক্তব্য প্রদান করেছিলেন। দাঙ্গাবাজ বাহিনী সকাল ১১.১৫ তে আক্রমণ করে রিপন কলেজ, বাঙ্গালীর শিক্ষার অন্যতম পীঠস্থান।

শিয়ালদহ স্টেশন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি বহু ঘটনার সাক্ষী। তবে শিয়ালদহের নির্মমতম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ১৬ই আগস্ট সকালেই। সকাল ৯টা নাগাদ প্রথম আক্রান্ত হয় শিয়ালদহ। তারপর কয়েক দিন ধরে প্রায় সর্বক্ষণ চলে লুঠপাট খুন মিছিল। কাছেই রাজাবাজার, সেটিই ছিল শিয়ালদহের অন্যতম দুর্বলতা। হয়ত আজও তাই আছে।

ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল শ্রী গোলক বিহারী মজুমদার আই.পি.এস, “ছেচল্লিশের আতঙ্কের দিনগুলো ভুলি নি”- শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, “…. রাজা বাজারের উপর দিয়ে আমাকে যেতে হতো। একদিন দেখলাম, গরু কেটে যেমন হুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখে, তেমনিভাবে দেখলাম, হাত পা কাটা হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে সব ঝুলিয়ে রেখেছে। বিভৎস আর নৃশংস সেই দৃশ্য।”

দেবকুমার বসু, “১৯৪৬ এর দাঙ্গার কয়েকটা দিন” নামে একটি লেখা লিখেছেন ২০০৬ সালে; সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “রাজা বাজারের সামনের ভিক্টোরিয়া কলেজ ও স্কুল। মেয়েদের কলেজ ও হোস্টেল একদম ফাঁকা, সব পালিয়েছে। কেবলমাত্র রাস্তার দোতলার জানালায় চারটি মেয়েকে খুন করে রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে, কে বা কারা। এই নৃশংসতা ও বিভৎসতা যারাই দেখেছেন, তারাই অনুভব করতে পারেন যে, আমাদের মতো, যুবকেরা কেনো উত্তেজিত হয়ে ক্ষিপ্ত হবে। কেউ এই হোস্টেলের দিকে তাকালে রাস্তার দিকের জানালাগুলি ইট গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া আছে, দেখবেন।”

প্রায় ২০০ বছরের পুরানো কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ক্লাব। গণহত্যার দিন বিকাল ৪.২০ তে মুসলমান বাহিনী আক্রমণ করে বেঙ্গল ক্লাব।রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীট সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার মধ্যে পড়ে। সেখানে এমন একটিও হিন্দু বাড়ী ছিল না যেটি মুসলিমদের হাতে আক্রান্ত হয়নি। এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত ছিল। লুঠপাটের সাথে চলেছিল অবাধ গণধর্ষণ।

এ কোনো সাধারণ সংগ্রাম ছিল না, ছিল ‘জিহাদ’, ‘কাফের’ হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ। আগামী দেড়দিনব্যাপী ‘আল্লাহো আকবর”, “নারা-এ-তকদীর, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বনিতে ব্যাপ্ত হয়ে থাকলো মহানগর, আগুনে জ্বলতে লাগলো হিন্দুদের স্থাবর-অস্থাবর যা কিছু। ইতিমধ্যে ১৭‌ই আগস্ট গার্ডেনরীচ টেক্সটাইল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আবদুল্লা ফারুকির নেতৃত্বে উন্মত্ত মুসলিম জনতা মেটিয়াব্রুজের লিচুবাগান বস্তির কেশোরাম কটন মিলের কয়েকশো  হিন্দু শ্রমিককে হত্যা করে। দাঙ্গার নারকীয়তায় ফুঁসে ওঠে কলকাতার হিন্দু সমাজ। ১৭ই আগষ্টের রাতে ইসলামের এই জিহাদের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে ঘুরে দাঁড়াল কলকাতার বুকে প্রায় ৮০০ হিন্দু ছেলের দল। এদের মধ্যে ছিল বাঙালি, বিহারি, উড়িয়া এবং পাঞ্জাবি- একত্রিত হিন্দু সমাজ। এই কালান্তক দাঙ্গায় হিন্দুদের জন্য যখন সর্বত্র সর্বনাশ অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখন‌ই অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো আবির্ভূত হন শ্রী গোপাল মুখোপাধ্যায় ওরফে গোপাল পাঁঠা। সঙ্গে পেলেন যুগল ঘোষ এবং ভানু বোসদের মতো তর তাজা কিছু বাঙালি প্রাণ। দু দিনে মুসলমানদের হাতে পাঁচ হাজারের ওপর মানুষের সুপরিকল্পিত খুনের পর শুরু হলো সেই রাত থেকে হিন্দুদের পাল্টা মারের এক অবিশ্বাস্য রুদ্ধশ্বাস প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-প্রতিশোধের তিন দিন। রক্তে আদায় করা রক্তের ঋণ।

হরেন ঘোষের মাধ্যমে আগে থেকেই খবর পেয়েছিলেন জিহাদি পাকিস্তানপন্থীদের হাওড়া ব্রিজ সহ মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, টালা ট্যাংকের মতো কলকাতার বেশ কিছু স্থাপত্য কে বোম দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা, গঙ্গার এপারের পুরো কলকাতা সহ আজকের পশ্চিমবঙ্গের অর্ধেকের বেশি এইভাবে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার ছক। এই নাশকতা  রুখে দেবার সংকল্প নিয়ে নেতাজির আদর্শে বলীয়ান গোপাল মুখোপাধ্যায় তলে তলে সংঘবদ্ধ করেছিলেন একটি অকুতোভয় যুবকদের বাহিনী। ধর্মের গ্লানি এবং স্বধর্মীয়দের এই অসহায়তা দেখে গোপাল পাঁঠা রাতারাতি ৮০০ জন হিন্দু যুবককে নিয়ে গড়ে তুললেন এক সশস্ত্র বাহিনী – ভারত জাতীয় বাহিনী। তাঁর নির্দেশ ছিল- ‘একজন হিন্দুকে খুন হতে দেখলে দশজন মুসলমানকে হত্যা করবে তোমরা। কিন্তু মুসলমান পশুদের মতো কোনো মহিলা বা শিশুর গায়ে হাত দেবেনা।’ এক‌ইভাবে বিজয় সিং নাহার স্থানীয় হিন্দু যুবকদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী’। তাঁকে সাহায্য করেন কংগ্রেস নেতা ইন্দুভূষণ বিদ, দেবেন দে এবং ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চ্যাটার্জী। এগিয়ে আসে হিন্দু মহাসভা। স্থানীয় ক্লাবগুলি, যেমন বাগবাজারের জাতীয় যুব সংঘ ও দেশবন্ধু ব্যায়াম সমিতি, বৌবাজারের হিন্দু শক্তি সংঘ, পার্কসার্কাসের তরুণ ব্যায়াম সমিতি ও আর্য বীর দল, এন্টালি ব্যায়াম সংঘ, হাওড়ার সালকিয়ার তরুণ দল, শ্রীরামপুরের মিতালি সংঘ প্রভৃতিও যথোপযুক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শিয়ালদার ভানু বোস, যুগল ঘোষ, বসু মিত্র কিংবা শ্যামবাজারের কালুর মতো হিন্দু যুবকরা সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে। পরবর্তীতে গান্ধীজির সাথে দেখা করে গোপাল পাঁঠাকে অস্ত্রসমর্পণ করতে বলা হলে ক্ষাত্রবীর্যের মূর্ত প্রতীক গর্জে ওঠেন- ‘একটি পেরেক‌ও যদি আমার হিন্দুভাইদের রক্ষাকল্পে, নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, আমি সেটিও সমর্পণ করবো না।’ নৃশংসতার জবাব কয়েকগুণ নৃশংসতার মাধ্যমে দেওয়া হলে এবার পিছু হঠে মুসলিম লীগ। লাল বাজারের কন্ট্রোলরুমে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল হতাশ সুরাবর্দীকে। মুসলিমদের প্রাণরক্ষার্থে কলকাতায় আর্মি নামান সুরাবর্দী। ২২শে আগস্ট শহরে দাঙ্গার পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৬ থেক ২০ আগস্ট, ১৯৪৬… কলকাতার বুকে – পুরোটা একটা ঘটনাক্রম। একটা যুদ্ধের শুরু আর শেষ- পুরোটাই একটা ঘোষিত ধর্মযুদ্ধ। আর যুদ্ধে কতটা ক্ষয়ক্ষতি হলো তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল যুদ্ধে কে জিতলো সেটা। আর এই ধর্মযুদ্ধে আমরা, হিন্দুরা জিতেছিলাম। সেই বিজয় উৎসব উৎযাপিত করতে হবে। ১৬ই আগস্ট থেকে ২০শে আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং নয়, এ আসলে হিন্দুদের সফল প্রতিরোধ এবং প্রতিশোধের ইতিহাস, যে ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্ম হিন্দুদের গর্বিত করবে। এই পাঁচদিন ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়। আসুন, সকল হিন্দুর কাছে এই বিজয়বার্তা পৌঁছে দিই এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই বিজয়োৎসব পালন করি।

কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম

মানবতা আর দানবতার সহাবস্থান মানেই মানবতার বিনাশ। যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে দানবের মনে শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটানো সম্ভব হত, তাহলে মা দুর্গা মহিষাসুরের মাথায় বাবা বাছা বলে মাতৃস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতেন, তাকে বধ করতেন না; শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়ে রাক্ষসদের সামনে নৈতিকতার প্রবচন দিতেন, রাবণকে গুষ্ঠিশুদ্ধু নিকেশ করতেন না; শ্রীকৃষ্ণ মামা কংসকে, শিশুপালকে হত্যা না করে বাঁশীর মধুর সুরের মূর্ছনায় মোহিত করে তাদের ভাল মানুষ বানিয়ে ফেলতেন।

স্বয়ং ভগবানও অসুরদের তোয়াজ করে মানুষ বানাতে পারেন নি, তো আমরা কোন ক্ষেতের মূলো! তাই এই সত্যকে স্বীকার করতে হবে যে, মানবতাকে রক্ষা করার একটাই পথ আছে। আর সেটা হল দানবতার বিনাশ। সেইজন্যই ঋগ্বেদ বলেছে –
কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্যম।
অপঘ্নন্তো অরাবণঃ।।
সারা বিশ্বে মানবতার বিস্তার ঘটাও, অর্থাত বিশ্বব্যাপী সনাতনী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা করো এবং সাথে সাথে অসুরদের বিনাশ করো। এই বৈদিক মন্ত্র হিন্দুদের জন্য স্পষ্ট লাইন অফ অ্যাকশন নয় কি?

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “কোন লোক হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয়। একটি শত্রু বৃদ্ধি হয়।” এর অর্থ এই যে, যারা ধর্মান্তরিত হচ্ছে, তারা এমন এক দর্শনে বিশ্বাস করতে শুরু করছে, যে দর্শন আমাদের হিদেন অথবা কাফের, অর্থাত শত্রু হিসেবে বিবেচিত করতে শিক্ষা দেয়। শুধুমাত্র তা ই নয়, আমাদের মত যারা তাদের মতাদর্শে অবিশ্বাসী, তাদের বিরুদ্ধে অনন্তকাল যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাদের তথাকথিত পবিত্র গ্রন্থগুলোতে।

এখন প্রশ্ন হল, যারা আমাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রেখেছে, আমাদেরও কি তাদের শত্রু বলে বিবেচিত করাই উচিত নয়? আমরা কি হায়নার সাথে কোলাকুলি করে নিজেদের নিরাপদ রাখতে পারবো? আমরা কি বিষধর সাপের সাথে এক ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চাইবো? এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর যদি আমাদের জানা থাকত তাহলে পাকিস্তানের সৃষ্টি হত না, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং হত না, নোয়াখালি হত না, চুকনগর হত না, দেগঙ্গা, নলিয়াখালি, কালিয়াচক, ধূলাগড়, বসিরহাট ইত্যদির কোনটাই হত না।

এইজন্যই নিজের বাড়ির দেওয়ালে স্টিকার দুটো লাগিয়ে দিলাম। একটা স্টিকার শত্রু কে, সেটা চেনাবে। আরেকটা স্টিকারে আছে লাইন অফ অ্যাকশন। আপনারাও নিজের নিজের বাড়িতে এই স্টিকার দুটো এমন জায়গায় লাগান, যাতে বারবার ধ্রুবতারার মত আপনার বাড়ির সকলের পথনির্দেশ করতে থাকে।

বাড়িতে নারকেল গাছ লাগানোর প্রস্তুতি নিন

হিন্দু ধর্মে নারকেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারকেল হিন্দুদের সমস্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। পুজোর সময়, ঘটে জল দিয়ে ভরাট করার পরে নারকেল উপরে স্থাপন করা হয়। এটি মঙ্গল গ্রহের প্রতীক। ঈশ্বরের কাছে নারকেল উৎসর্গ করা হয়। তাই ধার্মিক হিন্দু হয়ে বেঁচে থাকতে হলে বাড়িতে #নারকেল_গাছ🌴 লাগানো প্রত্যেক হিন্দুর অবশ্য কর্তব্য।

নারকেল গাছ লাগাতে হলে প্রথমেই মাটিতে একটা গর্ত করতে হবে। তার জন্য দরকার হবে শাবল অথবা লোহার রড। আছে বাড়িতে? না থাকলে পাশের বাড়ি থেকে ধার করবেন না, নিজের বাড়িতে একাধিক শাবল রাখার ব্যবস্থা করুন। শুধুমাত্র মাটিতে গর্ত করা নয়, প্রয়োজনে সাপ খোপ মারতেও কাজে লাগবে।

গাছ বড় হলেই ডালপালা ছাঁটাই করতে হবে। তারজন্য একটু লম্বা কাটারি কয়েকটা এনে বাড়িতে রাখুন, মাঝে মাঝে ধার দিন। নিজে ব্যবহার করুন, পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যবহার করতে শেখান।

এরপরে ডাব ধরবে। ডাবের জল স্বাস্থ্যকর। কিন্তু ডাবের জল খেতে হলে হাসুয়া বা কাস্তে দরকার হবে। কিনে নিন। শুধুমাত্র ডাব কাটতে নয়, আগাছা নির্মূল করার কাজেও লাগবে।

গাছে নারকেল ধরলেই বাঁদরের উপদ্রব শুরু হবে। এদের সামলানোর জন্য তীর ধনুক রাখুন। কয়েকটা গুলতি এবং প্রচুর ছোট পাথর জমা করে রাখুন। বাড়ির ছাদে বোল্ডার পাথর জমিয়ে রাখুন। বাঁদরদের শায়েস্তা করার জন্য এগুলো খুবই উপযোগী।

জমিতে যাতায়াত করলে সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়। তাই বাড়িতে কয়েকটা শক্তপোক্ত লাঠি রাখুন।

গ্রামে গ্রামে হিন্দুদের বাড়িতে বাড়িতে এইভাবে নারকেল গাছ লাগানো, তার রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত ব্যবস্থা করতে না পারলে হিন্দু হয়ে বাঁচতে পারবেন? হিন্দু হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে নিজে লাগান এবং নারকেল গাছ লাগানোর উপযোগিতার কথা আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধবদের বুঝান এবং তাদের বাড়িতেও যাতে নারকেল গাছ লাগানোর ব্যবস্থা হয়, তা সুনিশ্চিত করুন। এই মুহুর্তে হয়তো আপনি নারকেল গাছ লাগাতে পারছেন না, কিন্তু ভবিষ্যতে লাগানোর পরিকল্পনা অবশ্যই করুন এবং এখনই গাছ লাগানোর সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন।

ধর্মাবতার

ধর্মাবতার কহিলেন, “শোনো বাপু যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করিয়া তুমি তোমার হত দরিদ্র প্রতিবেশীদের মনে ঈর্ষার সঞ্চার করিয়াছো। তোমার এই বিধ ঘোরতর অপরাধই ইহাদের তোমার সম্পদ লুন্ঠনে প্রবৃত্ত করিয়াছে। সুতরাং তোমার গৃহে সম্পন্ন ডাকাতিতে আমি ইহাদের কোনরূপ অপরাধই দেখিতে পাই না। অপরাধ তোমারই। “

গৃহস্থ কহিল, “কিন্তু ধর্মাবতার, লুণ্ঠনের সাথে সাথে এই ডাকাতেরা আমার বৃদ্ধ পিতাকে নৃশংস ভাবে হত্যাও করিয়াছে। এই অপরাধের কি শাস্তি হইবেক না!”

ধর্মাবতার কহিলেন, “তুমি এই নিরীহ দরিদ্র মানুষদের ডাকাত সম্বোধন করিয়া মানবতার অপমান করা বন্ধ করো। আর তোমার পিতার মৃত্যুর জন্য ইহাদের কী রূপে দায়ী করো? তোমার বৃদ্ধ পিতা নিশ্চয়ই ইহাদের বাধা প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। সেই কারণেই বচসার সূত্রপাত। তোমার পিতার মৃত্যু একটি কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ। ইহার অর্থ তুমি বুঝিলে আমার এই চেয়ারে তুমিই আসীন হইতে।”

“কিন্তু ধর্মাবতার! আমার পত্নীকে ইহারা ধর্ষণ করিয়াছে। ইহার কি কোনও বিচার নাই?” গৃহস্থ কহিলেন।

ধর্মাবতার কহিলেন, “যৌবনের ধর্ম হে! ইহার বেগ সামাল দেওয়া সাধু সন্ন্যাসীদের অসাধ্য। ইহারা তো সাধারণ মানুষ। তোমার স্ত্রী নিশ্চয়ই সুন্দরী এবং যুবতীও! ইহাদের দোষ দাও কেন হে!”

গৃহস্থ বুঝিলেন আইন এবং আদালতের মহিমা ……..

আপনারাও কি বুঝিতে পারিয়াছেন?

পদানত জাতির মুক্তির ইতিহাস সর্বদাই লোহার কলম আর রক্তের কালি দিয়ে লেখা হয়েছে।

হিন্দুদের পরনির্ভর মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে হবে। রাজ্য সরকার কী করছে? কেন্দ্র সরকার কী করছে? বিজেপি কী করছে? তৃণমূল কী করছে? ইত্যাদি প্রশ্নের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু ওরা কিছু না করলে হিন্দু সমাজ অসহায়; এই মানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে হবে।

এক সময় দেশ পরাধীন ছিল। তখন স্বাধীনতার জন্য সমাজকেই লড়াই করতে হয়েছিল। বিদেশী সরকারের দমনপীড়নকে তুচ্ছ করেও স্বাধীনতাকামী জনতা বিভিন্ন ভাবে এই লড়াই লড়েছিল। গান্ধীর বৃটিশ সরকার মুখাপেক্ষী আবেদন নিবেদনের নীতির পরিণাম এই স্বাধীনতা নয়। বিনয়-বাদল-দীনেশ, বাঘা যতীন, মাস্টারদা সূর্যসেনের পরাক্রম; যতীন দাস, প্রীতিলতাদের আত্মবলিদান; রাসবিহারী, সুভাষ বোসদের রণকৌশলের সামনে বৃটিশ সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল, আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম।

বাংলাদেশের কথা ছেড়ে দিন, আজ আমাদের দেশেও কি হিন্দুদের মানবিক অধিকার সুরক্ষিত? মুর্শিদাবাদ, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, নদীয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে হিন্দুদের সাথে কথা বলে দেখুন এইসব এলাকায় হিন্দুরা কতটা নাগরিক অধিকার অথবা মানবিক অধিকার ভোগ করে থাকে। এই অধিকার সুনিশ্চিত করবে কে? প্রকৃতির নিয়মে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। যদি আজও নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সরকারের কাছে অসহায় আবেদন নিবেদনের গান্ধী প্রদর্শিত পথে চলার পরম্পরা আঁকড়ে ধরে বসে থাকি, তাহলে আমরা আবার মাটি হারাবো, নিজভৃমে পরবাসী হবো। মনে রাখতে হবে সরকার সবসময় শক্তিমানের সুরেই কথা বলে।

বাংলাদেশের হিন্দুরা ওখানকার মৌলবাদীদের পাল্টা মারতে শুরু করলেই ওখানে যা হত, সেটাকেই সিভিল ওয়ার বলা হত। এছাড়া অন্য কোনও রাস্তা কি আছে? আমি নিশ্চিত যে বাংলাদেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, হিন্দুদের উপর এই অত্যাচার বন্ধ করতে পারবে না। তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুদের সামনে আজ বিকল্প কি কি? হয় লড়াই করে ভাগ্য পরীক্ষা করতে হবে, না হয় তিলে তিলে প্রতিদিন মরতে মরতে একদিন শেষ হয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের যেকোন হিন্দুর সাথে কথা বলে দেখুন, আমার কথা মিথ্যা নয়। এই বিকল্প কি শুধুমাত্র বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্যই? একেবারেই না। যে কোনও দেশে জেহাদী মৌলবাদীদের সাথে অমুসলমান যারা যারা ঘর করছে, তাদের প্রত্যেকের সামনে এই দুটি মাত্র বিকল্পই আছে।

সময় থাকতে নিজেদের ভবিষ্যত নির্ধারণের দায়িত্ব আমরা যদি নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে না পারি, তবে কেউ আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। সরকারের প্রতি আমাদের বার্তা এটাই হওয়া উচিত- With you, without you, inspite of you- জেহাদী মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমরা আমাদের এই লড়াই লড়বো। এই লড়াই আমরা শুরু করিনি, কুরুক্ষেত্রে পান্ডবদের মত আমরা রেসপন্ড করতে বাধ্য হচ্ছি মাত্র। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর যে ধারাবাহিক নির্যাতন চলছে তা শুধুমাত্র বাংলাদেশের হিন্দুদের সমস্যা নয়। আজ যদি প্রতিরোধ তৈরি করা না যায় তবে আজ বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা ই হবে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ভবিষ্যত, অবশিষ্ট ভারতের হিন্দুদের ভবিষ্যত, সারা বিশ্বের সমস্ত অমুসলমানদের ভবিষ্যত।

হিন্দুদের যদি এই অন্যায়, অত্যাচার, অপমানের হাত থেকে মুক্তি পেতে হয়, ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। আর পদানত জাতির মুক্তির ইতিহাস সর্বদাই লোহার কলম আর রক্তের কালি দিয়ে লেখা হয়েছে।

প্রসঙ্গ মুসলিম এলাকায় সঙ্ঘশাখা

সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা একটা ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা ইঙ্গিত করেছিলেন – শহরে ৩% এবং গ্রামাঞ্চলে ২% স্বয়ংসেবক তৈরি করতে পারলেই সঙ্ঘ আদর্শে সম্পূর্ণ সমাজকে প্রভাবিত করা সম্ভব হবে। আজ সঙ্ঘ সমগ্ৰ হিন্দু সমাজের গন্ডি পেরিয়ে মুসলমানদের মধ্যেও সরাসরি সঙ্ঘের কাজ শুরু করতে চলেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সঙ্ঘের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত সঙ্ঘের অধিকারীরা নেবেন এটাই স্বাভাবিক। বাইরে থেকে সমালোচনা করা সমীচীন নয়। তবে কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

প্রথমত, সঙ্ঘের উদ্দেশ্য হিন্দু সমাজের মধ্যে একটা সংগঠন তৈরি করা নয়, বরং সমগ্র হিন্দু সমাজকে সংগঠিত করা- এই নীতির বর্তমান ব্যাখ্যা কী হবে?

দ্বিতীয়ত, ভারতে বসবাসরত মুসলমানদের কি সঙ্ঘ হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করছে? এর জন্য শুধুমাত্র ডিএনএ এক হ‌ওয়াই কি যথেষ্ট? তাদের বর্তমান চিন্তন প্রক্রিয়া, দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিচার্য বিষয় নয়?

তৃতীয়ত, আরবি নাম, আরবি সংস্কৃতি, আব্রাহামিক অসহিষ্ণু দর্শনে আস্থা, দারুল ইসলামের লক্ষ্য, জেহাদ প্রতিটি মুসলমানের পবিত্র কর্তব্য বলে বিশ্বাস, গজবা-এ-হিন্দের স্বপ্ন, লাভ জেহাদ, ধর্মান্তরকরণের জন্য দাওয়াত, ব্লক ভোটের রাজনীতি – এই সমস্ত কিছু বজায় রেখেও কি ভারতে বসবাসরত মুসলমানেরা হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে?

চতুর্থত, অসহিষ্ণু আব্রাহামিক দর্শনে অনাস্থা রাখলে, কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদকে অস্বীকার করলে, ভারতীয় পরিচয়কে মুসলিম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে স্থান দিলেও কাউকে মুসলমান হয়ে থাকার অনুমতি কি ইসলাম আদৌ দেয়? অর্থাৎ, একজন ইমানদার মুসলমান কি এক‌ই সাথে হিন্দু হতে পারে?

আমার কাছে মুসলমানদের নিয়ে সঙ্ঘের এই আগ্রহের যৌক্তিকতা স্পষ্ট নয়। একথা সত্য যে আমাদের সকলের ডিএনএ এক। ঠিক যেমনভাবে দেবতা এবং দৈত্যদের ডিএনএ এক। উভয়েই ঋষি কশ্যপের বংশধর। কিন্তু ডিএনএ এক হলেই সমাজ এক হয় না। গান্ধীজি এই ঐক্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন এবং তার ফলশ্রুতিও আমরা জানি। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা একান্ত আবশ্যক। ভারতের মুসলমানরা আসলে যে হিন্দু – এই উপলব্ধি মুসলমানদের যতদিন না হচ্ছে ততদিন আমরা এক হতে পারবো না। তাড়াহুড়ো না করে ওদের সময় দেওয়া হোক।

ফুরফুরার ইতিবৃত্ত

আজ থেকে প্রায় সাতশ বছর আগের ঘটনা। বঙ্গদেশের অধিকাংশ তখন মুসলিম শাসনাধীন। হুগলী জেলার বালিয়া বাসন্তী তখনও মুসলমানদের দাসত্ব স্বীকার করে নি। স্বাধীনচেতা বাগদীদের রাজত্ব সেখানে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। রাজার নাম সম্ভবতঃ চন্দ্রনাথ কিংবা গোবিন্দচন্দ্র। কিন্তু মুসলিম শাসকদের চোখে তখন বিশ্বজুড়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে পৃথিবীর সর্বত্র। তাই বালিয়া বাসন্তী কীভাবে কাফেরদের অধীনে থাকতে পারে! অতএব হজরত শাহ হোসেন বুখারীর নেতৃত্বে সেনা অভিযান শুরু হল বালিয়া বাসন্তী দখলের জন্য। এই সৈন্যদলের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন হজরত মওলানা মনসুর বাগদাদী।

বালিয়া বাসন্তী আক্রমণকারী এই বাগদাদী মহাশয় হলেন ফুরফুরা শরীফের প্রাণপুরুষ দাদা হুজুর নামে পরিচিত মহম্মদ আবু বকর সিদ্দিকীর পূর্বপুরুষ। আরও পিছনের দিকে গেলে দেখা যায় যে এই দাদা হুজুর হলেন নবী হজরত মহম্মদের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিকীর বংশধর। অর্থাৎ আজকের ত্বহা সিদ্দিকী এবং আব্বাস সিদ্দিকীরা হলেন বালিয়াবাসন্তী আক্রমণকারী বাগদাদীদের উত্তরসূরি।

এখন ওদের মুখ থেকেই শোনা যাক এই হানাদারেরা কিভাবে বালিয়াবাসন্তী দখল করেছিল-

প্রাতঃকালে মোসলেম সৈন্যগণ বাগ্দী রাজার অধীনস্থ গ্রামসমূহ আক্রমণ করেন। বাগদী রাজা বহু সৈন্যসহ তাঁহাদের সম্মুখীন হন। ইহার ফলে উভয় পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হয়। ইহার ফলে বাগ্দী রাজার বহু সৈন্য হতাহত হয়। পরদিবস পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কিন্তু বাগ্দী রাজার সৈন্য সংখ্যা মোসলেম সৈন্য সংখ্যার দ্বিগুণ দেখিয়া মোসলেম সৈন্যগণের মধ্যে শাহ সোলায়মান এবং অন্যান্য বহু বোজর্গ-সৈন্য শহীদ হইলেন। ইহাতে সেনাপতি বিষম চিন্তায় পতিত হইয়া অশ্রু বিসর্জ্জনপূর্ব্বক আল্লাহতায়ালার নিকট মোনাজাত করিতে লাগিলেন এবং ফতেহ হইবার নিমিত্ত দোয়া চাহিয়া নিদ্রাভিভূত হইলেন চিন্তিত সেনাপতি সৈয়দ হোসেন বুখারী (রহ.) নিদ্রিত অবস্থায় এক আশ্চর্য ও অভিনব স্বপ্ন দেখলেন। তিনি দেখলেন নিদ্রিত অবস্থায় তাঁহাকে স্বপ্নে যেন কেহ বলিতেছেন ঐ বাগ্দী রাজার বাড়ীতে জিঁয়ত কুন্ড-নামে এক পুষ্পরিণী আছে, তথায় দুষ্ট জেন প্রভৃতি বাস করে। আহত সৈন্যগণকে উহাতে নিক্ষেপ করিলে, উক্ত দুষ্ট জেনগণ উহাদের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া অসীম বলশালী করিয়া তোলে। এই নিমিত্ত উহার সৈন্যসংখ্যা হ্রাস পাইতেছে না। যদি কোনও উপায়ে উহাতে একখ- গরুর গোশত নিক্ষেপ করা যায়, তাহা হইলে উক্ত দুষ্ট জেন প্রভৃতি পলায়ন করিবে। সুতরাং উহাদের সমস্ত শক্তি বিনষ্ট হইয়া যাইবে। (ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস, হযরত মাওলানা আবু জাফর সিদ্দিকী সাহেবের লিখিত ও প্রকাশিত, তৃতীয় সংস্করণ, প্রকাশকাল-আষাঢ়, ১৩৪৩ বাংলা, পৃঃ ৪-৫)।

উক্ত নিগুঢ়-রহস্য জানতে পেরে তিনি আল্লাহপাকের দরবারে শোকর গোজারী করতে লাগলেন এবং কি উপায়ে উক্ত কাজ সমাধা করা সম্ভব হয় সে বিষয়ে চিন্তা করতে থাকেন। এমন সময় খবর পেলেন যে, উক্ত রাজা মেহমানদেরঅত্যন্ত সমাদর করেন এবং আহারাদি না করিয়ে কোনরূপেই তাঁকে বিদায় দেন না।

এই সংবাদ প্রাপ্তে তিনি পুরোহিতের বেশ ধারণ করত জপমালা হস্তে লইলেন এবং একখ- গরুর গোশ্ত প্রচ্ছন্নভাবে লইয়া এক বৃক্ষতলে বসিয়া জপ আরম্ভ করিলেন। (কারণ হাদীসে আছে الحرب خدة) বাগ্দী রাজা উক্ত পুরোহিতের সংবাদ প্রাপ্ত হয়ে দাসবৃন্দকে আদেশ করিল যে, তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করত উত্তমরূপে আহারাদি করাইয়া বিদায় দাও। দাসবৃন্দ নানা উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য লইয়া পুরোহিতের নিকট গমন করিলেন এবং আহার করিবার নিমিত্তে তাঁহাকে পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তিনি তাহাদের প্রতি ভ্রক্ষেপও করিলেন না। দাসবৃন্দ বিফল মনোরথ হইয়া রাজার নিকট প্রত্যাবর্তন করিল। রাজা স্বয়ং তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বিনয় পূর্বক তাঁহাকে রাজবাড়ি ভ্রমণ করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিতে সবিশেষ অনুরোধ করিলে, পুরোহিত বেশধারী হযরত শাহ হোসেন বোখারী (রহ.) উত্তরে জানাইলেন যে, আমি বহুদিন পর্যন্ত স্নান করি নাই এবং স্নান না করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিতে পারিব না। অদ্য জিঁয়ত কু- পুষ্করিণীতে স্নান করিয়া আহারাদি সম্পন্ন করিলে গোনাহ সমূহ মোচন হইবে। ইহা বিধাতার আদেশ। তন্নিমিত্ত এখানে উপস্থিত হইয়াছি।তদ্শ্রবণে বাগদী রাজা অতিশয় আনন্দিত হইল। তাঁহাকে জিঁয়তকুন্ডে পুষ্করিণী দেখাইয়া তথায় স্নান করিতে অনুরোধ করিলেন এবং অন্দর মহলে প্রবেশ করিলেন। তিনি এই সুযোগে আপন উদ্দেশ্য পূর্ণ করিলেন। গোশতখ- পুষ্করিণীতে নিক্ষিপ্ত হইবা মাত্র এরূপ ভয়াবহ শব্দ উত্থিত হইল যে, রাজবাড়ির সমস্ত মানুষ সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পতিত হইল। ইত্যবসরে তিনি ঐ স্থান হইতে প্রস্থান করত নিজ শিবিরে উপস্থিত হইলেন। উল্লিখিত শব্দটি আর কিছ্ই নহে, জিঁয়ত-কুন্ডে যে সকল দুষ্ট জেন প্রভৃতি ছিল, তাহারা ঐরূপ বিকট শব্দ করিয়া ঐ স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছিল

পরদিন সকালে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হল। উভয়পক্ষের বহু সৈন্য হতাহত হল। বাগদী রাজা আহত সৈন্যগণকে পূর্বের ন্যায় জিয়ত কুন্ডে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ঐদিন একজন সৈন্যও ক্ষমতাসম্পন্ন হইল না, বরং পানিতে নিমজ্জিত হইয়া মরিয়া গেলঅতঃপর মুসলমান সৈন্যগণ সহজেই যুদ্ধে জয়লাভ করিলেন। বেগতিক দেখিয়া বাগ্দী রাজা অবশিষ্ট সৈন্যসহ বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর রাজার দেশের দিকে পলায়ন করিল (ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস, ৩য় সংষ্করণ, ১৩৪৩ বাংলা, পৃষ্ঠা ৫-৬)

এইভাবে প্রতারণা করে বালিয়াবাসন্তী রাজ্যে খিলাফত কায়েম করার পরে সেখানে ফুরফুরা শরীফ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই প্রসঙ্গে ‘ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস ও হজরত আবু বকর সিদ্দিকী(রহঃ) এর বিস্তারিত জীবনী’ গ্রন্থে গ্রন্থকার হজরত আল্লামা মহম্মদ রুহল আমিন(রহঃ) লিখেছেন – চারিজন মুসলমান সৈন্য পলায়নপর রাজ সৈন্যের দিকে ধাবিত হইলেন এবং কাগমারী মাঠে তাহাদের সহিত যুদ্ধ করিয়া শহীদ হইয়া গেলেন। সেনাপতি এই সংবাদ শুনিয়া তাহাদের মৃতদেহ আনাইয়া বালিয়াবাসন্তীতে দফন করতঃ তদুপরি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করাইয়া দেন। তাহাদের মস্তক দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিল বলিয়া উহা কাগমারী মাঠেই সমাহিত করা হইয়াছে। শত শত লোক এখনও চারি শহীদের মাজারে জিয়ারত করিয়া থাকে। বালিয়াবাসন্তীতে মুসলিম গৌরব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হইলে তথাকার নাম হজরতে ফুরফুরা শরীফ রাখা হয়। এর অর্থ এই যে ফুরফুরা শরীফ হল আরব সাম্রাজ্যবাদীদের বালিয়াবাসন্তী বিজয়ের গৌরবের প্রতীক। এখন অনেকেই এই বইয়ে যা লেখা আছে তার ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। আমার কাছে এর ঐতিহাসিক সত্যতার থেকেও এই বইয়ের ভুমিকায় লেখকের একটি স্বীকারোক্তিকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে – পুস্তকের প্রত্যেকটি বিষয় পীর সাহেব কেবলার  সুযোগ্য সাহেবজাদাগণের অনুমতি ও অনুমোদন লইয়া প্রকাশিত (পৃষ্ঠাঃ ৪)।

এবারে আসুন ফুরফুরা শরীফের সাথে যার নাম বারবার উচ্চারিত হয় সেই দাদা হুজুর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক। মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিকি ১৮৪৫ সালে ফুরফুরা শরীফে পিতা আব্দুল মুক্তাদির সিদ্দিকীর ঘরে জন্ম গ্ৰহণ করেন। ইনি ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিকির সরাসরি বংশধর এবং সবার কাছে দাদা হুজুর পীর কেবলা নামে পরিচিত।

পশ্চিমবঙ্গগ, বাংলাদেশ, আসাম ও অন্য আরও অনেক স্থানে তাঁর খলিফাগণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। তাদের মোট সংখ্যা ছিল ৫৭০ জন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ১১০০ মাদরাসা এবং ৭০০ মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ‘জমিয়তে উলেমা’ নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এবারে পীর সাহেবের চিন্তাধারা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাক।

খিলাফত আন্দোলন চলাকলীন একবার গান্ধীজী মওলানা সওকত আলি, মহম্মদ আলি প্রমুখ কয়েকজন মুসলমান সহ টিকাটুলি মসজিদে পীর সাহেবের সাথে দেখা করেন এবং তাকে কংগ্রেসে যোগদান করতে অনুরোধ করেন। জবাবে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে তিনি কোরান-হাদিসের পক্ষপাতী। কংগ্রেস য়দি ভারতে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য এবং ইসলামের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয় তবে কংগ্রেসে যোগ দিতে তার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু কংগ্রেস এর মধ্যে কোনও একটির বিরোধিতা করলে আর তার কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা পাবে না। পরে গান্ধীজীর অনুপস্থিতিতে পীর সাহেব মওলানা মহম্মদ আলীকে জানিয়ে দেন যে কংগ্রেসের উপরে তার আস্থা নেই। তিনি বলেন আমাদের কাছে আগে দ্বীন, পরে দেশ। দ্বীন ছেড়ে দিয়ে দেশের উদ্ধার আমাদের অভিপ্রেত নয়(ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস ও হজরত আবু বকর সিদ্দিকী-এর বিস্তারিত জীবনীঃ পৃষ্ঠা- ৫৮)।

১৯৩০ সালের ১লা এপ্রিল বৃটিশ ভারতে বাল্যবিবাহ নিরোধক আইন কার্যকর হয়। এই আইনকে সারদা আইনও বলা হত। পীর সাহেব বলেন এই আইন মুসলমানদের কোরান ও হাদীসের পরিপন্থী। কারণ কোরানে বাল্যবিবাহের অনুমোদন আছে। স্বয়ং নবী হজরত মহম্মদ নাবালিকা আয়েশাকে বিবাহ করেছিলেন। তাই এই সারদা আইনের প্রতিবাদে পীর সাহেব মনুমেন্টের নিচে একটি বিশাল জমায়েতের আয়োজন করেন এবং বলেন এই আইনের দ্বারা মুসলমানদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মুসলমানদের সামনে দুটি পথ খোলা আছে- জেহাদ অথবা হিজরত। শুধু সভা করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি। তিনি নিজে এই আইন ভেঙে একজন নাবালিকার বিয়েও দেন।

পীর সাহেব সহি ইসলামি রীতিনীতির সাথে কোনও রকম আপোষ করতেন না। একবার উত্তরপাড়ায় একটি সভায় গিয়েছিলেন। সমবেত হিন্দু জনতা তাকে বন্দেমাতরম ধ্বনিতে স্বাগত জানালে তিনি গাড়ির উপর থেকে ‘চোপরও’ বলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন। জনতা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের পাশে হিন্দুদের একটি প্রস্তরমূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এই পীর সাহেব। ফলস্বরূপ এই মূর্তি আর বসানো সম্ভব হয় নি।

কলকাতার টালায় একটি অস্থায়ী মসজিদ ছিল। সেখানে মুসলমানরা গরু জবাই করার চেষ্টা করলে স্থানীয় হিন্দুরা বাধা দেয় এবং মসজিদটির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হয়। মুসলমানরা তাড়াতাড়ি ওই মসজিদের বিল্ডিং পাকা করার কাজ শুরু করে। আদালত থেকে ইনজাংশন জারী হওয়ার পরেও জোর করে এই নির্মাণকাজ চলতে থাকলে অবশেষে সেনা নামানো হয়। এই পরিস্থিতিতে এই হজরত পীর সাহেবের নির্দেশে সুরাবর্দী এবং হাজী মুসা শেঠ এগিয়ে আসেন। মুসা শেঠের আর্থিক সহায়তায় এবং সুরাবর্দীর ইঙ্গিতে কয়েক হাজার মুসলমান জমায়েত হয়ে রাতারাতি পাকা মসজিদ তৈরি করে ফেলে।

পোড়াদহ নামের একটি জায়গায় জনৈক সুফি সুলেমানের বাড়িতে ইসালে সওয়াব অনুষ্ঠানে গরু কাটার পরিকল্পনা করা হয়। স্থানীয় হিন্দুরা বাধা দিলে এই হজরত পীর সাহেব নিজে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। ফলে কয়েক হাজার মুসলমান সেখানে জমায়েত হয়। এই ভীড় দেখে হিন্দুরা পিছিয়ে যায় এবং নির্বিঘ্নে সেখানে গরু জবাই করা হয়।

তিনি মুসলিম লীগের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আল্লাহ ও রসুলের আদেশে মুসলিম লীগ মুসলমানদের একতাসূত্রে আবদ্ধ করার কাজ করছিল বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। বহুবার কৃষক প্রজাপার্টি এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি ফতোয়া জারী করেছিলেন।

বৃদ্ধাবস্থায় পীর সাহেব একটি অসিয়ত বা উইল করে গিয়েছিলেন। সেই অসিয়তে তার ভক্তদের জন্য কিছু নির্দেশাবলী তিনি লিখে রেখে গিয়েছিলেন। তার মধ্য থেকে কয়েকটি নির্দেশের উল্লেখ এখানে করা দরকার-

১১) হিন্দুদের পূজা পার্বনে, মেলা, তেওহার, গান-বাজনার স্থানে সাহায্য করবেন না এবং সেখানে যাবেন না। পূজায় পাঁঠা, কলা, ইক্ষু, দুধ ইত্যাদি বিক্রয় করবেন না। ভেট দেবেন না, দিলে গুনাহ হবে।

৫১) কেউ শেরেক গুনাহ করবেন না। যেমন হিন্দুর পূজায় ভেট দেওয়া, পাঁঠা, কলা, দুধ বিক্রি করা….. কেউ ধান-চাউলকে মা লক্ষ্ণী বলবে না।

৫২) অমুসলমানদের তৈরি মিষ্টান্ন ইত্যাদি না খাওয়া ভাল। কারণ তাদের কাছে যা হালাল, আমাদের কাছে সেগুলো হারাম।

‘ফুরফুরা শরীফের ইতিহাস ও হজরত আবু বকর সিদ্দিকী(রহঃ) এর বিস্তারিত জীবনী’ গ্রন্থে গ্রন্থকারের বর্ণনা অনুযায়ী হজরত পীর সাহেব পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে মুসলমানরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গায় মুসলমানদের জন্য অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। মসজিদ অথবা কবরস্থান নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তিনি ‘প্রধান সেনাপতি রূপে সাহায্য করিয়া মুসলমানদিগের জাতীয় সহানুভুতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছিলেন’।

একবার কোনও একটি পরিস্থিতিতে একজন ইংরেজ সাহেব রায় দিয়েছিলেন যে দুটি বড় মসজিদের সামনে গান-বাজনা সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে কিন্তু ছোট ছোট মসজিদের সামনে নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে গান বাজনা চলতে পারে। প্রত্যুত্তরে পীর সাহেব বলেছিলেন যে আল্লাহতালার কাছে বড় মসজিদ আর ছোট মসজিদের পার্থক্য নেই। তাই কোনও মসজিদের সামনেই গান-বজনার অনুমতি থাকা উচিত নয়।

ফুরফুরা শরীফ সম্পর্কে কিছু তথ্য সকলের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এই তথ্য আমার মনগড়া নয়। প্রত্যেকটি তথ্যের রেফারেন্স আছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে ফুরফুরা শরীফের দর্শন এবং লক্ষ্য সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার দায়িত্ব পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিচ্ছি। তবে একটা কথা না বললেই নয়। সেটা হল আজকে আব্বাস সিদ্দিকী দলিত-মুসলিম ঐক্যের যে ভেক ধরেছে, সেটা বালিয়াবাসন্তী দখলের সময়ে তারা যে ছল-চাতুড়ির আশ্রয় নিয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি। তাদের ইতিহাস প্রমাণ করে যে তারাই আসলে দলিতদের প্রকৃত দলনকারী। তাই সাধু সাবধান।

অভিজিত কি আবার রাজিয়াকে ফিরে পাবে?

অভিজিত ঘোষ। পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানার অন্তর্ভুক্ত একটি ছোট গ্রামের ছেলে। বয়স ২৬ বছর। ভালোবেসে বিয়ে করে ওই জেলার‌ই মন্তেশ্বরের মেয়ে রাজিয়া খাতুনকে। রাজিয়ার বয়স ২১ বছর। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে রেজিস্ট্রি হয় ২৯-০৯-২০২০ তারিখে।

২৮-১১-২০২০ তারিখে রাজিয়ার বাবা এবং মা অভিজিতের বাড়িতে আসে এবং তাকে আশ্বস্ত করে যে এই বিয়ে তারা মেনে নিয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা রাজিয়াকে ডাক্তার দেখানোর অছিলায় তারা সাথে নিয়ে যায় নিজেদের বাড়িতে। এর পর থেকে অভিজিতের সাথে রাজিয়ার যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাজিয়ার সাথে দেখা করতে চাইলে রাজিয়ার বাড়ির লোকেরা অভিজিতকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয় এবং বিভিন্ন ভাবে তার ক্ষতি করার হুমকি দিতে থাকে। মেমারি থানায় অভিযোগ দায়ের করতে অসমর্থ হলে বাধ্য হয়ে পূর্ব বর্ধমান পুলিশ সুপারের কাছে ০৫-০২-২০২১ তারিখে লিখিত অভিযোগ জানায় অভিজিত।

এরপর থেকে আজ পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে কোনও রকম সহযোগিতা পায় নি অভিজিত। উল্টে তার কাছে একটি নোটিশ আসে যে রাজিয়া বিবাহ বিচ্ছেদ চায় এবং নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে যদি আদালতে উপস্থিত না হয়, তবে এক তরফা বিচারের মাধ্যমে রায় ঘোষণা করা হবে। ইতিমধ্যে অভিজিতের পিতৃবিয়োগ হয়েছে এবং আদালতে হাজিরার দিনেই ঘাটের কাজ সম্পন্ন হ‌ওয়ার কথা।

এই পরিস্থিতিতে হিন্দু সংহতির সাহায্য প্রার্থনা করে অভিজিত জানিয়েছে যে সে প্রথমে আদালতে হাজিরা দেবে, তারপরে পিতৃশ্রাদ্ধের আবশ্যক কাজ করবে। কারণ সে রাজিয়াকে ফিরে পেতে চায়। হিন্দু সংহতির পক্ষ থেকে কালনা কোর্টে একজন উকিল নিযুক্ত করা হয়েছে অভিজিতের পক্ষে। আগামীকাল শুনানি হতে চলেছে।

আসুন আমরা সবাই মিলে অভিজিত আর রাজিয়ার পাশে দাঁড়াই যাতে এই চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে তারা দুজনে আবার পরস্পরকে ফিরে পায়।

পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র কারা?

হরিয়ানায় বেসরকারি চাকরিতে ভূমিপুত্রদের জন্য ৭৫% সংরক্ষণ হল। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হল ভূমিপুত্র কারা সেটা সংজ্ঞায়িত করা।

১৯৪৬ এর নির্বাচনে এই বঙ্গদেশের ৯০% এর বেশি মুসলমান পাকিস্তানের দাবির পক্ষে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল। ১৯৪৭ এর ২০ শে জুন অখণ্ড বঙ্গের মুসলিম প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন‌ও পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষে এবং পাকিস্তানে যুক্ত হ‌ওয়ার বিপক্ষে ভোট দেয় নি। যারা মনেপ্রাণে চেয়েছিল গোটা বাংলাই পাকিস্তানে যুক্ত হোক, কিন্তু সেটা না হ‌ওয়ায় এই নাপাক পশ্চিমবঙ্গেই থেকে গেল, এবং এই মাটির উপরেই জায়গায় জায়গায় মিনি পাকিস্তান গঠনের প্রক্রিয়া চালাতে থাকলো, তাদের কি ভূমিপুত্র বলা যায়?

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গরাজ্য। সুতরাং অন্যান্য রাজ্য থেকে যেকোনও লোকের এখানে এসে বসবাস করার, ব্যবসা করার, চাকরি করার, লেখাপড়া করার সাংবিধানিক অধিকার আছে। কিন্তু এই অধিকারের কি কোনও সীমা থাকা উচিত নয়? এই অধিকারের যদি কোনও সীমা না থাকে তাহলে যারা স্বভাবত আগ্রাসী নয়, তাদের অস্তিত্ব থাকবে? তাদের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে? যেখানে সহোদর ভাইদের মধ্যে প্রত্যেকের অধিকার শুধুমাত্র ‘গুড‌উইল’ এর উপরে রক্ষিত হয় না, আইনের উপরে নির্ভর করতে হয়, সেখানে হিন্দু বলেই বাঙ্গালী হিন্দুদের উপরে অবাঙ্গালী হিন্দুর আগ্রাসনের সম্ভাবনা নেই এবং থাকলেও সেটা মেনে নেওয়া উচিত একথা ভাবা কতটা বাস্তব সম্মত হবে? এই দৃষ্টিতে‌ও পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র কারা এবং তাদের অধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি সর্বোপরি তাদের অস্তিত্ব কিভাবে সুরক্ষিত থাকবে সেটা নির্ধারিত হ‌ওয়া উচিত।

এই সমস্ত বিষয়ে বাঙ্গালীকে প্রথমে মুক্তমনা হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ঘরে ফিরলো সামিমা

আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্য প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছে। ফলাফল স্বরূপ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র‌ও স্থানান্তরিত হচ্ছে প্রতিদিন। সবাই বলছে খেলা হবে। কিন্তু খেলার রাশ ধীরে ধীরে বাঙ্গালী হিন্দুর হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে এটা অনস্বীকার্য।

হিন্দু সংহতি একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে এই ইস্যুতে আওয়াজ তুলছে, দীর্ঘদিন ধরে বাঙ্গালী হিন্দুদের সতর্ক করে চলেছে। কিন্তু এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি রাজনৈতিক মঞ্চে এখনও গুরুত্বহীন। বিজেপিও এই সমস্যার সঙ্গে সম্পর্কিত NRC এবং CAA ইস্যুতে ব্যাকফুটে চলে গিয়েছে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন যদিও এই সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান নয়, তবুও এই আইন আপাতত জনবিস্ফোরণের চেইন রিয়্যাকশনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়েও কার‌ও কোনও উচ্চবাচ্য দেখা যাচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে এই সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হ‌ওয়ার পাশাপাশি  হিন্দু সংহতি রামায়ণে বর্ণিত কাঠবিড়ালির মত তার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে চেষ্টা করে চলেছে এই সমস্যার সমাধানের অন্যতম একটি পথের দিশা দেখাতে। এই পথ ধর্মান্তরকরণ রোধের পথ, এই পথ ঘরে ফেরানোর পথ।

আজ ঘরে ফিরলো সামিমা (নাম পরিবর্তিত)। সে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মেয়ে। কলেজ ছাত্রী। বয়স ২০ বছর। সহপাঠী সমীরের হাত ধরে তার এই সনাতনী সমাজে প্রত্যাবর্তন। একদিকে ‘দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী’-র স্বভাবসিদ্ধ প্রতিক্রিয়া, অপরদিকে তথাকথিত উদার হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল প্রত্যাখ্যান- এর জাঁতাকলে পিষ্ট সমীর সামিমার জুটিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে কে? তাদের সামাজিক সম্মানের সাথে সাথে নিরাপত্তা দেবে কে? তাদের আইনী সহায়তা দেবে কে? তাদের পায়ের তলায় মাটি আর মাথার উপরে ছাদের ব্যবস্থা করবে কে?

আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করে চলেছি। আপনারাও করুন। এই কাজে আমাদের সাথে থাকুন।

Design a site like this with WordPress.com
শুরু করুন